

ধরিত্রী মাতা
আজ হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। আমরা ছিলাম ছয়ভাইবোন। গ্রামে আমাদের বেশ কিছু চাষ জমি ছিল, কয়েকটি মাছ ভর্তি পুকুর ছিল। গোয়ালভরা গরুও ছিল। তারমধ্যে তিনটি গাই ছিল। আর ছিল বাবার মিষ্টির দোকান। বেশ হাসিখুশি সুন্দর সচ্ছল পরিবার। আমরা ভাইবোনেরা সবাই পড়ালেখা করতাম৷ পড়াশোনার ফাঁকে চাষ জমিতে চাষের কাজও করতাম। ছোটবেলায় খেত মজদুরের জন্য মাঠে জলখাবার নিয়ে যাওয়া, আগাছা তুলে দেওয়া, ধানের চারাগাছের মুঠি (ব্যান বিড়ে) এক জমি থেকে অন্য জমিতে বয়ে নিয়ে যাওয়া, ওদের জন্য পানীয় জল নিয়ে যাওয়া প্রভৃতি নানান কাজে আমরা সহায়তা করতাম। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিবপ্রসাদ ইনস্টিটিউশন, তারপর গঙ্গাধর হাইস্কুল। পরে প্রভাতকুমার কলেজ। চাকরী পাওয়ার পূর্বে দুই বছর টিউশন পড়াতাম৷ তার মাঝে বর্ষাকালে ধান রোপণের কাজ আর শীতকালে ধান গোছানোর কাজে পরিবারের সঙ্গ দিয়েছি৷ গরমে, বর্ষায় কিংবা শীতে একটু আধটু বিরক্তিবোধ করতাম বটে কিন্তু মায়ের আদরে, ভালোবাসায়, স্নেহ, মায়া, মমতায় আর চটপটে খাওয়ার লোভে অনায়াসে তা করে দিতাম৷
আমি ছোটোবেলা থেকেই খাদ্য রসিকই ছিলাম৷ মায়ের রান্না করা সব ব্যঞ্জনই খেতাম৷ অন্য ভাইবোনেরা যেখানে ভাতের সাথে তেতো তরকারি, শাক চচ্চড়ি, মুড়ি ঘন্ট কিংবা মাছের টক অতটা পছন্দ করতো না, কিন্ত সেই সময় আমি মায়ের দেওয়া সবটাই খেতাম৷ দুপুরে খাওয়ার শেষে দুধ দিয়ে একমুঠো ভাত না খেলে যেন পেটের এক কোণ খালি থাকতো, তা আমি না বুঝলেও মা বুঝে নিতেন৷ এইরকম গ্রীষ্মের দিনে আমাদের গাই গুলো প্রায়ই গাভীন থাকা অবস্থায় একটু করে কমই দুধ দিতো৷ প্রতিদিন আমি লক্ষ্য করতাম দুধ গরম করা খাপরি (এক রকমের মাটির / এ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি) এর ধারে ধারে দুধের সর জমছে না৷ মুড়ির সঙ্গে পাওয়া দুধও কেমন যেন পাতলা পাতলা হয়ে আসছে৷ দিদিদের কাউকে জিজ্ঞাসা করলে, বলতো; গাই এখন পাতলা দুধ দেয়৷ আমার আবার সর বিহীন পাতলা দুধ মোটেও পছন্দ ছিল না৷ একদিন আমায় দুধ দোয়ার সময় বাছুর (গাইয়ের বাচ্চা) ধরার জন্য মা আমাকে গোয়াল ঘরে নিয়ে যায়৷ আমি দেখলাম গাভীন গাইগুলো পা ছড়িয়ে নেচে নেচে (দুধ না দেওয়ার নাটক) করে তিনটের মধ্যে একটি মাত্র গাই দুধ দিল৷ তাও আবার এক গেলাস (আধ লিটার) এর মতো৷ গোয়াল ঘর থেকে বাড়ির মাঝে ছিল একটি পুকুর৷ আমি বাড়িতে আগেই চলে এসেছিলাম, মা আসছেন পিছে পিছে৷ পুকুরে হাত পা ধুয়ে বাড়ি আসতেই দেখি বালতিতে অর্ধেক দুধ ভর্তি৷ আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম; বালতির কোণেই দুধ ছিল একটুখানি, এখন পুকুরে মায়ের হাত পা ধোয়ার পরে এতটা কি করে হলো! পরের দিনও ওই একই ভাবে বেড়ে গেছে লক্ষ্য করলাম৷ খাওয়ার সময় ভীষণ পাতলা৷ আমি রেগে কাঁই ৷ দিদি দাদারা হাসাহাসি করছে৷ আমরা তখন গরম বিহীন কাঁচা দুধও খেতাম (পান করতাম)৷ পরের দিন আমি মুড়ি বাটি গোয়াল ঘরে নিয়ে হাজির৷ মা'কে বললাম; আমার মুড়ি বাটিতে গাইর দুধ দুইয়ে দাও৷ "দুধ ছেঁকে খেতে হয়, ওই দোয়ানো দুধে অনেক ময়লা থাকে", এই বলে; মা ও দাদা-দিদিরা সবাই ভয় দেখাতে লাগলো৷ আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা৷ ওই দুধই আমার চাই, মুড়ির বাটিতে৷ যাইহোক ওখানেই আমি দুধ দিয়ে খেলাম মুড়ি৷ দাদাকে বললাম; আচ্ছা এখানে দুধ কত মোটা (ঘন) আর বাড়িতে খেলেই পাতলা হয় কেন? দাদা বলেছিল; তুই একটা বুদ্ধু! পুকুরে হাতপা ধোয়ার সময় - বালতিতে যতটা দুধ থাকে তার চাইতে বেশী জল মিশিয়ে, মা নিয়ে যায় বাড়িতে, আমাদের সবার খাওয়ার জন্য৷ অঙ্ক বুঝতে পারিস আর এইটা বুঝিস না৷ বুদ্ধু কাঁহিকা৷
যখন সঠিকভাবে ওই রহস্য বুঝতে পারলাম তখন অনেক বড় হয়ে গেছি৷ কোনও মা সন্তানকে জল মিশিয়ে দুধ দিতে চায় না বরং সকল সন্তানেরা যাতে দুধেভাতে থাকে আর কষ্ট না পায়, তারই সমাধান করে সহজ উপায়ে৷ ওটা ছিল সমাধানের সহজ উপায়৷
মায়ের হৃদয়ে অনেক কষ্ট যন্ত্রণা থাকলেও সন্তানদের বুঝতে দেয় না৷ সেসব হৃদয়ের যন্ত্রণা বুঝতে সন্তানের অনেক সময় লেগে যায়৷ বহু বছর মা নেই৷ অনন্তলোকে চলে গেছেন৷ আজ ধরিত্রী দিবসে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ আর এও মনে পড়লো আমরা এখন ধরিত্রী মাতার কষ্ট একটুও বুঝতে পারছি না৷ হয়তো অনেক সময় পরে বুঝবো৷ মা'তো সন্তানের সকল অন্যায় - অত্যাচার নীরবে সহ্য করেন৷ ধরিত্রী মাতাও নীরবে সহ্য করে চলেছেন৷ একদিন বুঝবো ধরিত্রী মাতার কষ্টের কথা আর তখন........
মায়ের অপত্য স্নেহের কোনো তুলনা হয় না। মা'তো নয়.... একেবারে সাক্ষাৎ ভগবতী!
আপনিও পাঠাতে পারেন আপনার এলাকার তথ্য, আপনার লেখা ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প বা আপনার আঁকা ছবি।
আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে শর্তসাপেক্ষে তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করব, আপনাদের প্রিয় এই ওয়েবসাইটে।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত হতে চাইলে এই লেখার উপর ক্লিক করুন 👈

