

গরুরগাড়ী ও ভূতবাবুদের ভূতকথা
আশিতে আসিওনা কথাটি এঁদের কাছে প্রযোজ্য নয়৷ নিতান্ত কয়েকটা বছর মাত্র৷ মাঝেমধ্যে ৭৭ বছর বয়স্কা পার্বতীদেবী ও চুরাশির জলধর বাবুর কাছে গ্রামের অনেক পুরোনো কথা শুনতে পাই৷ কথায় কথায় আজ এক পুরোনো কথা শুনলাম৷ শতবর্ষ পুরোনো কথা৷ এককালে #জরারনগর গ্রামের ভূতনাথ সামন্ত, ভূতনাথ রাউৎ এবং রমনাথ দাস নামের তিনজন ব্যক্তির বেশ ঘনিষ্ঠ বন্ধুন্ত্ব ছিল৷ তাদের তিনজনের তিনটি গরুরগাড়ী ছিল৷ তিনজন ব্যবসায়ী বন্ধু জরারনগর গ্রাম ও আশপাশের গ্রাম ও হাট থেকে ধান, চাল ও পাট ক্রয় করে নরঘাটের পাঁচখালি হাটে বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে রাতের বেলায় রওয়ানা দিতেন৷ ওইসব মালপত্র পাঁচখালি হাট থেকে হলদী নদী হয়ে নৌকোয় করে কলকাতায় চলে যেত৷ কলকাতা থেকে নৌকোয় করে আসা নানান দ্রব্য যেমন; মশলাপাতি, লংকা, জিরা, সরিষাতেল প্রভৃতি ভূষিমাল দ্রব্য, সাঁচিগুড়, তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যাদি ক্রয় করে গরুরগাড়ী ভর্তি করে উনারা নিয়ে আসতেন৷ বাড়িতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যেত৷ সপ্তাহে দুইদিন ছিল হাটবার৷ প্রত্যেকটি গরুরগাড়ির দুটি করে বলদ থাকতো৷ ক্ষমতায় ভীষণ বলবান ছিল যেমন দেখতেও ভীষণ সুন্দর ছিল চাঁদ বাঁকানো শিং-এর বলদগুলো ৷
ভূতনাথ সামন্ত ছিলেন দুই পুত্র সন্তানের জনক৷ একজন ছিলেন কৃষক বনমালী, অন্যজন ব্লক অফিসের কর্মচারী - মহাদেব৷ সবাই ছিলেন পরিশ্রমী৷ সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি৷ ভূতনাথ রাউৎ মহোদয়ের তিনজন পুত্র সন্তান; বিহারীলাল, অশোককুমার ও বিনোদকুমার৷ বিহারীলাল ছিলেন শিক্ষক৷ অবসরের পরেও ছাত্র পড়াতেন, বাংলা, ইংরেজী ও অংকে দক্ষ ছিলেন৷ অশোকবাবু এবং বিনোদবাবু চাকরী করেন দিল্লী ও বঙ্গে, সবাই প্রতিষ্ঠিত৷ রমনাথের দুই কন্যারত্না; বিনোদিনী ও বিন্দুবাসিনী৷ আত্মীয়গুণে ছিলেন ওরা দুই ভগিনী, গুণী দুই সুন্দরী, দুই রমণী৷
ঝড় হোক বা জল, কিংবা শীত হোক বা প্রচন্ড গরম - তিনজন ব্যবসায়ী বন্ধুদের দেখা যেত সর্বদা একসঙ্গে সকালে পাঁচখালি হাটে৷ হাটে নিয়ে যেতেন গরুরগাড়ী ভর্তি করে এবং নিয়ে আসতেন ভর্তি করে নানান মালপত্র ৷ সেইসময়কালে এখনকার মতো কংক্রিটের রাস্তা ছিল না৷ জরারনগর গ্রামের রাস্তা ছিল কাঁচা অর্থাৎ মাটির৷ তাই বর্তমান জাগৃতি হাটের দক্ষিণ দিকে শ্মশানের পরেই ছিল হাঁড়ি পড়্যা৷ যেখানে গ্রামবাসীদের বাড়ির ভাঙা হাঁড়ি ফেলা হতো ৷ সেখানেই রাখা হতো ওদের গরুরগাড়িগুলো৷
একদিন অমাবস্যার বর্ষার রাতে ফিরছেন ওরা তিনবন্ধু, মালপত্রে ভরা গরুরগাড়ি৷ কাঁচাপাকা রাস্তায় চন্ডীপুর পেরিয়ে বাজকুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন৷ বাজাবেড়িয়ার কাছে একটি বটগাছ ছিল৷ রাতের অন্ধকারে সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না৷ মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি৷ দূর থেকে ওরা দেখতে পেলো ওই বটগাছ থেকে কিছু একটা ঝুলছে৷ মনে হয়েছে একটি ভূত! গাছে চড়ছে আর নামছে৷ ভয়ে ওরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলতে ভুলে গেল খানিকক্ষণ ৷ গরুর গায়ে ছড়ির ঘা দিতে ভুলে গেল ৷ অনেক কাদা ঠেলে আসা গরুগুলোও ছিল ক্লান্ত, ছড়ির মার না খেয়ে ওরাও চলতো না৷ মার না খাওয়া গরুগুলো সামনে এগোতে চাইলো না আর বোবা হয়ে যাওয়া দুই ভূতনাথ আর রমনাথ ওরাও খানিকক্ষণ ভূত দেখে স্তব্ধ হয়ে থাকলো৷ গুণে গুণে শ্বাস নিতে লাগলো৷ কিছুক্ষণ পরে ওদের পেছনে আসা যাত্রীভরা গরুরগাড়ীতে থাকা লোকজন বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখতে পেলো গাছে একটি ছেঁড়া কাপড় ঝুলে আছে৷ বৃষ্টির জলে ভিজে ভারি হয়ে আছে কিন্তু জোর বাতাসে মাঝে মাঝে নড়ছে৷ ততক্ষণে মহাবলবান তিনবন্ধুর ধড়ে প্রাণ এলো৷
আজ তাদের অনেকেই নেই এই ইহজগতে৷ গতকাল থেকে বিদ্যুতের ঝলকানি সমেৎ প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে৷ গ্রামের পুকুরগুলো সব ভর্তি ৷ বর্ষায় ব্যাঙ-এর ডাক শুনতে পাওয়া যাচ্ছে ৷ অমাবস্যা এগিয়ে আসছে তাই অন্ধকার রাত৷ কিন্তু ভূতের ভয় নেই আর কারুরই! শ্মশানের কাছে বাড়ি, কত শত শবদাহ হতে দেখা জলধর বাবু ও পার্বতীদেবীর কোনও ভয় নেই৷ একটুকুও ভয় নেই.......ভূতের!
আপনিও পাঠাতে পারেন আপনার এলাকার তথ্য, আপনার লেখা ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প বা আপনার আঁকা ছবি।
আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে শর্তসাপেক্ষে তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করব, আপনাদের প্রিয় এই ওয়েবসাইটে।
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত হতে চাইলে এই লেখার উপর ক্লিক করুন 👈

