রতিকান্তের প্রথম কোলকাতা ভ্রমণ।

👨🏻‍🎨 দেবায়ন কর
✍️ সমরেশ সুবোধ পড়িয়া

রতিকান্তের প্রথম কোলকাতা ভ্রমণ

আজ থেকে অনেক বছর পূ্র্বের কথা৷ ইংরেজী ১৯৮২ সনের মাঘ মাসের তৃতীয় সপ্তাহ৷ জেঁকে বসা শীতটা একটু কমে আসছিল৷ বার্লি ডিবেতে মুড়ি ও বাতাসা ভরে রতিকান্ত চললো কোলকাতা, তার জ্ঞাতি ভাই – হারাধন দাদার সঙ্গে৷ রতিকান্ত ক্লাস নাইনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সদ্য টেন ক্লাসের ছাত্র, বয়েস তখন মাত্র পনের৷

সেইসময় বর্তমান কোলকাতার নাম ছিল কলিকাতা৷ রতিকান্তের বাড়ি ছিল অধুনা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরীর এক প্রত্যন্ত গ্রামে৷ এখনকার তিন মেদিনীপুর অর্থাৎ পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলা মিলিয়ে আয়তনে ভারতবর্ষের মধ্যে বৃহত্তম জেলা – তদানীন্তন কালের অখন্ড মেদিনীপুর জেলা৷ হারাধন আর রতিকান্ত, দুইভাই চলেছে কোলকাতা৷ রথ দেখা আর কলা বেচার আশায়৷ অর্থাৎ আমন্ত্রণের কাজও হবে কলিকাতা শহর ভ্রমণও হবে৷

রতিকান্তের দাদা সুশান্তের বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণের অবিরাম বর্ষণের এক শুভদিনের সন্ধ্যায় এক শুভক্ষণে৷ যেহেতু ওরা দুইজন ছাত্র আর ছাত্রী, তাই চতুর্দশী প্রতিমারাণীর বিয়ের অবিলম্বেই নববধূরূপে স্বামীর ঘরে আগমন হয় নি৷ ডিসেম্বরে পরীক্ষা দিয়ে মাঘের বিশ তারিখে নববধূর আগমনের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেছিলেন উনার শ্বশুর মশাই – সুবোধচন্দ্র আর উনার পিতা – নির্মলেন্দুবাবু৷

প্রতিমারাণীর আগমনের স্মৃতিতে প্রীতিভোজের (বৌভাতের) আমন্ত্রণ জানাতে কলিকাতা চলেছে রতিকান্তরা৷ সেখানে সুবোধচন্দ্রের বড়ভাই স্বাধীনতা সংগ্রামী সুধীরচন্দ্র পড়িয়া থাকেন সপরিবারে, স্ত্রী – স্নেহলতাদেবী আর পুত্রত্রয় – রবীন্দ্রনাথ, রণজিৎ, রথীন্দ্রনাথ ও কন্যারত্না কল্যাণী৷ ওঁরা থাকতেন কেশব সেন স্ট্রিটের একটি বিশাল বড় বাড়ির দুই তলাতে৷ কুখ্যাত গুন্ডা ফাটাকেষ্ট’র বাড়ির কাছেই৷

সুধীরচন্দ্র, কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজে পড়াকালীন সর্বশিক্ষার বার্তাবাহক – জাতীয় শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র প্রামাণিক মহোদয়ের আহ্বানে ইংরেজ শাসক বিরোধী আন্দোলনে প্রায় দুইবছর জেল-এ কাটানোর পর ফুলমালঞ্চ এইচ-ই স্কুলের প্রধান শিক্ষক (সূত্র – ডি. মন্ডল, আঠিলাগড়ি, কাঁথি) হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরে উনি কেন্দ্রীয় আয়কর বিভাগে চাকরী গ্রহণ করেন৷ আয়কর বিভাগে চাকরীরত অবস্থায় কেশব সেন স্ট্রিটের বাসায় থাকতেন৷ ওখানেই হারাধনের সাথে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিল রতিকান্ত৷

শীতের দিনে ঝড়ঝড়ে লোকাল বাসে চেপে খেজুরি থেকে নরঘাট পৌঁছানোর পর হলদী নদীর খেয়া পেরোতে হলো চটি হাতে এক হাঁটু কাদা জল ঠেলে৷ তখন নরঘাটের ব্রীজ হয় নি৷ নৌকো খেয়া পেরিয়ে পায়ের কাদা ধুয়ে আবার একটি ঝড়ঝড়ে বাসে চেপে মেচেদা পৌঁছালো ওরা৷ মেচেদা থেকে হাওড়া লোকাল ট্রেনের দুটি টিকিট কেটে ট্রেনে চেপে বিশালাকার #হাওড়াস্টেশন এ পৌঁছালো৷ হাওড়া স্টেশনের বাইরে সারি সারি তাজমহল মার্কা দাঁড়িয়ে থাকা “হিন্দী-বাংলা সিনেমার কলাকুশলী সুন্দর- সুন্দরীদের নাম লেখা” বাসে চেপে কখনো ধুক-ধুক আর কখনো সাঁ-সাঁ বেগে পৃথিবীর সপ্ত আশ্চর্যজনক হুগলী নদীর উপর ঝুলন্ত #ক্যান্টিলিভার #হাওড়াব্রীজ দর্শন করতে করতে, প্রতিটিক্ষণে বকবক করে বুঝিয়ে যাওয়া হারাধন দাদার সাথে রতিকান্ত এই প্রথম ভূগোলে পড়া স্বপ্নে দেখা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলিকাতা শহরে “মাথায় হাত ঠেকিয়ে গঙ্গানদীকে প্রণাম করে” সশরীরে প্রবেশ করলো৷

কিছুটা রাস্তা বাসে যাওয়ার পর একটি জায়গায় বিশাল একটি লালবাড়ি দেখিয়ে হারাধনদাদা বললো রতিকান্তকে – এই বাড়িটা হচ্ছে; রাইটার্স বিল্ডিং, এটা মুখ্যমন্ত্রীর কার্য্যালয়৷ তারপর রাজভবনের গেট, ধর্মতলা, একবার ডানদিকে দেখিয়ে বললো – দেখ – ওটা আকাশবাণী ভবন, ওখান থেকে রেডিওতে গান এবং মহালয়ার স্তোত্র মন্ত্র, নাটক, আবৃত্তি ও কথা পাঠানো হয়ে থাকে৷ একে একে গড়ের মাঠ, শহীদ মিনার সব দেখালো৷ সেইসময় মেট্রোরেলের কোনও নাম গন্ধ ছিল না৷ এক একটি বিল্ডিং কিংবা প্রসিদ্ধ জায়গা রতিকান্ত দেখে আর তারপরে মাথায় হাত ঠেকিয়ে #মা_নাচিন্দার উদ্দেশ্যে প্রণাম করে এগিয়ে চলে৷ এইভাবে রতিকান্ত তার জেঠুর বাসায় পৌছুতে পৌঁছুতে তখন প্রায় দুপুর একটা৷

জেঠুর বাসায় সবার কলেজ ও অফিসের জন্য খাওয়ার সেই নটায় তৈরী হয়ে যায় আর শেষও হয়ে যায় দশ’টা – এগারো’টার মধ্যেই৷ রতিকান্তের পেটে তখন একসঙ্গে দুইতিনটে ছুঁচো বেদম ডন মেরে চলেছে৷ হাতমুখ ধোওয়ার জল দিল রতিকান্তের স্নেহময়ী জেঠাইমা স্নেহলতাদেবী৷ চটপট করে ডাল, বেগুন ভাজা আর গরমভাত করে দিতে – ওরা দুইজন সড়সড়িয়ে টেনে দিল গরমাগরম ভাত৷

শীতকালের বিকেল হয়ে আসছে৷ ওদের আবার ফিরে আসতে হবে, নরঘাটের জলকাদা ঠেলে৷ আমন্ত্রণের কাজ সেরে চটপট বেরিয়ে পড়লো হারাধনের হাত ধরে রতিকান্ত৷ আজব শহর কলিকাতা৷ বিশাল বিশাল অট্টালিকা আর গাড়ি ঘোড়ার পোঁ-পোঁ, হুট-হাট, হকারের লে-লে, ট্রামের ঘন্টা ‘টংটং’ আর নানান রকমের বিকট আওয়াজ কোলাহল আর চেঁচামেচি৷ সব মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতি সঙ্গে নিয়ে ফিরলো পঞ্চদশবর্ষীয় কৈশোর পেরিয়ে নব্য যুবক রতিকান্ত, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করা তার মা ভগবতীদেবীর কাছে৷

অট্টালিকার শহর কলিকাতা ছিল এককালে সারা ভারতবর্ষের রাজধানী৷ এক সময়ের খুবই ব্যস্ত শহর, আজ সেসব মনে হয় – এক আজব কাহিনী৷

আপনিও পাঠাতে পারেন আপনার এলাকার তথ্য, আপনার লেখা ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প বা আপনার আঁকা ছবি।
আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে শর্তসাপেক্ষে তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করব, আপনাদের প্রিয় এই ওয়েবসাইটে
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত হতে চাইলে এই লেখার উপর ক্লিক করুন 👈

Social Share

অনুসন্ধান !!

এখনকার খবর !!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *