খাবিতো খা ভাগ দিয়ে খা।

খাবিতো খা ভাগ দিয়ে খা।

দেখতে খানিকটা কুন্ডলী পাকানো ছোট সাপের আকার। কাঁচা অবস্থায় সবুজ আর পাকলে লাল রঙের। অনেকে "মিঠা বাবলা ফল" বলেন। আবার মেদিনীপুরের মানুষেরা বলেন - কিচমিচি ফল। এটি দু'তিন জাতের হয়ে থাকে। কাঁচা অবস্থায় একটু কসাড়ে / কষাটে হয় বটে, কিন্তু পাকলে মিষ্টিও হয় অনেক। ঝোপে ঝাড়ে, অগভীর জঙ্গলে কিংবা গ্রামের রাস্তার ধারে উঁচু অনুর্বর জমিতে বিশাল আকারের ঝাঁকড়া গাছ দেখা যায় - এই কিচমিচি গাছ। শীতের শেষে আর গরমের প্রাক্কালে এই ফলটি অনেকেই পছন্দ করে এবং এখনো করে থাকে। গাছের সারা গায়ে ধারালো কাঁটা তাই গাছটিতে চড়া ভীষণ কষ্টকর। তবুও কৈশোরের যুবা মনের কিশোর-কিশোরীদের ওই গাছে চড়ার নানান অভিজ্ঞতা আছে।

ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে দুটি কিচমিচি ফলের গাছ ছিল। একটি বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে আর একটি বড় পুকুরের পশ্চিম পার্শ্বে।  ছুটির দিনে পড়াশোনার ফাঁকে, পাড়ার অনেক বাচ্চা ঘাম দুপুরের পরে বিকেলবেলা ওই গাছের নিচে ঘুরঘুর করতো। তাতে বাদ যায় নি আমাদের  প্রতিবেশী জলধরকাকুর দুই কন্যারত্না - মণিকাঞ্চন ও অনিমা। একদিন ওরা গাছে চড়ে "চুপি চুপি" "পাকা পাকা" "মিষ্টি মিষ্টি" ফল "এক একটি" করে "ধরে ধরে" পাড়ছে। চুপি চুপি বলছি এই  কারণে যে; ওরা যা পেড়ে আনবে তার অর্ধেক আমাকে ভাগ দিতে হতো। ওরা আমায় সমান সমান ভাগ দিতে চাইতো বটে - কিন্তু আমার একটি খাই খাই ব্যারাম ছিল যা ওদের ভালো লাগতো না। সেটি হচ্ছে - ওরা যখন গাছে চড়ে ফলগুলি পাড়তে ব্যস্ত থাকতো - তখন আমি নিচে পড়ে থাকা ভাঙা কিচমিচি গুলো (যেগুলো ভাঙা হলেও পাকা, পুরুষ্টি এবং ভীষণ মিষ্টি) আমি খেয়ে খেয়ে সাবড়ে দিতাম। ওরা প্রথম প্রথম আমার দুষ্টু বুদ্ধি ধরতে পারেনি। কিন্তু আমার ছোটোবোন কনকলতা ওদের বলে দিতেই, যত্ত গন্ডগোল! তারপরই আমার মেজদিদির "এভারগ্রীণ পানিশমেন্ট" কানমলা খেতে হলো আমাকে।  দিদি বললো - বুড়ো ধাড়ি বাচ্চা! তুই গাছে উঠবি না। ওই কচি বাচ্চারা গাছে উঠবে, কাঁটায় হাত-পা ছড়বে আর তুই ধ্যাঙ্গড় - সব ভালো ভালো মিষ্টি ফল গুলো খেয়ে ফেলবি।  সেদিনের গরম গরম কানমলা খাওয়া কি কখনো ভোলা যায় ! উহু গরমের দিনে বড্ড গরম, তাই না!

এই গাছের কাঁটা বিঁধে গেলে বেশ যন্ত্রণা হতো। পুকুরের ধারে গাছ থাকলে জাল দিয়ে মাছ ধরা খুবই কষ্টকর ছিল। মাছতো জালে ধরা দিতো না বরং এই ফলের ছোবড়া গুলো বেশি করে ধরা দিতো জালে। একদিন মাছ ধরতে গিয়ে জাল ছাড়ানোর যন্ত্রণায় আমার বাবা বলে ফেললেন - এই কিচমিচির গাছটা কালই কেটে দেব। "কেটে দেব, কেটে দেব" বললেন শতবার! কিন্তু মা-বাবা কেউই কাটলেন না, তাঁদের শেষ জীবন পর্যন্ত। গাছকে তাঁরা সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। আজ প্রতিযোগিতার বাজারে জেতার নেশায় ঝগড়া-ঝাঁটি বিহীন জিন্দেগী বানানোর জন্য অনেকের ভালোবাসার গাছ দুটি কেটে দিয়েছি। তবে বাবা একটি কথা বলতেন; একটি গাছ কাটার আগে পাঁচটি গাছ লাগাবে। এখনো তা মেনে চলি এবং অপরকে এই কথাটি বারবার বলি। এখনো মায়ের তেঁতুল গাছটি কাটতে পারি নি। মা বলেছিলেন পাঁচটি গাছ লাগিয়েই কাটবি। কোথায় পাবো - তেঁতুল গাছ পাঁচটি লাগানোর জায়গা। থাক না ওই পুরোনো গাছ! 

আজ চার দশক পরে দেবুর পাঠানো ছবি দেখে আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেলো - সেইসব পুরোনো দিনের কথা! গ্রামের অনেকেরই বাড়িতে এই গাছটি ছিল - তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন - নিতাইবাবু, সুধীরবাবু, শ্রীপতিবাবু, সুধাংশুবাবু, সুরেশবাবু ও সত্যবাবু। এই গাছের একটি মাহাত্ম্য ছিল! হয়তো এই কাড়াকাড়ি - মারামারির যুগেও সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এখনো আছে। গাছটির মালিক কখনো একাই ফল ভোগ করেন না, অনেকেরই অধিকার আছে এই ফলের, আইনের পাতায় মালিকের একার অধিকার পাওয়া নয়, প্রকৃতির কাছে - এই গাছ থেকে পেড়ে খাওয়ার অধিকার! যেমন তাল খেজুরের। কুল, গুড়, অক্সিজেন আর পাতার !

অনেকদিন পরে দিদির কথা মনে পড়ে গেলো - 
খাবিতো খা ভাগ দিয়ে খা।  হা হা হা......
✍️ সমরেশ সুবোধ পড়িয়া

আপনিও পাঠাতে পারেন আপনার এলাকার তথ্য, আপনার লেখা ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প বা আপনার আঁকা ছবি।
আমরা বিচার বিশ্লেষণ করে শর্তসাপেক্ষে তা সর্বসমক্ষে প্রকাশ করব, আপনাদের প্রিয় এই ওয়েবসাইটে
আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সংযুক্ত হতে চাইলে এই লেখার উপর ক্লিক করুন 👈

Social Share

অনুসন্ধান !!

এখনকার খবর !!

2 thoughts on “খাবিতো খা ভাগ দিয়ে খা।”

Leave a Reply to Soilen Khatua Cancel Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *